
ব্র্যান্ড এবং বিজ্ঞাপন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাঃ
৬-৭ বছর আগের কথা । আমি তখন এক বিশ্বখ্যাত কোম্পানীতে ব্রান্ড ম্যানেজার হিসেবে কাজ করি । আমার ব্র্যান্ডের নতুন ক্যাম্পেইন শুরু করলাম । টিভি মিডিয়া ব্রেক হলো শনিবার রাতে । পরের দিন রবিবার সকালে আমাদের মাসিক অপারেশনাল মিটিং, যেখানে হেড-অফ-ফাংশনরা উপস্থিত থাকেন । মিটিং বসে প্রথমেই আমার তৎকালিন CFO, ভদ্রলোক ইন্ডিয়ান, প্রফেশনাল ক্যারিয়ারের বয়স আমার চাইতে অন্ত:ত দ্বিগুণ, জিজ্ঞাসা করলেন
“গালীব, কাল রাত থেকে তো আপনার টিভি শুরু হলো । তা সেলসে ইম্প্যাক্ট কি ?”
উত্তরে আমি কি বলব অনেক্ষণ ভেবেও বুঝে উঠতে পারলাম না ।
.
এত বছর এই পুরানো গল্প কেন ? কারণ, শুধু সেই CFO ভদ্রলোকই নন, অনেকের মাথার ভিতর এই ধারণা আছে যে এ্যাড দেয়া মানেই সাথে সাথে লাফিয়ে লাফিয়ে সেলস্ বাড়তে থাকা ! এমন কি আমরা যারা মার্কেটিং প্রফেশনালস তাঁদের অনেকের ভেতরেও এই ধারণা কাজ করে ।
.
মার্কেটিং প্রফেশনে আমি এ পর্যন্ত ঠেকে এবং দেখে যতটুকু শিখেছি তাতে এতটুকু বলতে পারি যে এ্যাড দিয়ে সাথে সাথে সেলসে বাড়ে না । অন্ত:ত FMCG ইন্ডাস্ট্রীতে না । কখনই না । ভাবছেন তাহলে এ্যাড দেবো কেন ? কেনই বা কোম্পানীগুলো তাহলে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা এ্যাডের পেছনে খরচ করে ?
.
উত্তরটা একটু পরে দিচ্ছি । তার আগে একটু মনে করে দেখুন তো শেষ কবে আপনি নিজে এ্যাড দেখার সাথে সাথে কোন প্রোডাক্ট কেনার জন্য দোকানে দৌড় দিয়েছেন ? বেশীর ভাগের উত্তরই হবে কোনদিনই না । তাই যদি হয় তবে আপনার কনজ্যুমার কোন আক্কেলে টিভি-রেডিও-অনলাইনে-পেপারে এ্যাড দেখেই জিনিষটি কেনার জন্য দৌড়ে দোকানে চলে যাবে ? বিচার-বুদ্ধি তো তাঁদেরও আছে । না কি !
.
তাহলে এ্যাডের কাজটা কি ? এ্যাডের আসল কাজ ‘পারচেজ’ ঘটানো না । বরং বরং এ্যাডের আসল কাজটি হলো ‘প্রোডাক্ট’ কিংবা ‘সার্ভিস’টি নিয়ে মাথার ভেতর একটু খানি জায়গা করে নেয়া । যাকে মার্কেটিংএর ভাষায় বলা হয় ‘Consideration set’ । এখনকার পৃথিবীর হাজার হাজার একই ধরণের প্রোডাক্টের রাজ্যে আপনার এ্যাডটি যদি আপনার ব্র্যান্ডটিকে কনজ্যুমারের মাথার ভেতর এতটুকু জায়গা করিয়ে দিতে পারে সেটি কিন্তু মোটেও ফেলনা কিছু নয়, বরং রীতিমত যুদ্ধ জয়ের মতই কঠিন কাজ । এরকম হাজার-হাজার, লাখ-লাখ মানুষের মাথার ভেতর যখন আপনার ব্র্যান্ডটি সামান্য হলেও জায়গা করে ফেলে, তখন আস্তে আস্তে শুরু হয় এক জটিল সাইকলিজিক্যাল প্রক্রিয়া, যাকে মনো:বিজ্ঞানের ভাষায় Active decision making process-ও বলে । আগ্রহী কনজ্যুমারগণ তখন ধীরে ধীরে আপনার ব্র্যান্ড নিয়ে ইনফর্মেশন খুঁজতে থাকে । কি আছে এতে ? কি নেই ? কি কি ব্যপারে এটি অন্য ব্রান্ডের চাইতে ভাল কিংবা খারাপ ? একে অন্যকে এটির ব্যপারে জিজ্ঞাসা করে, সাজেশন দেয়া নেয়া করে । এই কথা-বার্তা কিন্তু আপনার ব্র্যান্ডের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার । এটিকে মার্কেটিংএর ভাষায় বলে Word of Mouth (WoM)। আর যাঁরা রকীব হাসানের তিন গোয়েন্দা পড়েছেন তারা বলতে পারেন ‘ভুত-থেকে-ভুতে’ । Empirical evidence বলে যে যেসব ব্র্যান্ড WoM ডমিনেট করে, সেসব ব্র্যান্ডই ক্যাটাগরীতে সবচেয়ে বেশী সেলস জেনারেট করে ।
.
অবশেষে, সমস্ত ইনফর্মেশন-ধাঁধা-অনিশ্চয়তা আর সাইকলিজির হাজারটা জটিল পথ পাড়ি দিয়ে একজন মানুষ আপনার ব্র্যান্ডটি কেনার কিংবা না-কেনার ডিসিশন নেন । এই পুরো যাত্রা পথে আরও অনেক কিছুই প্রভাব রাখে – ডিস্ট্রবিউশন, প্যাকেজিং, দাম, কম্পিটিটিরের এ্যাক্টিভিটি, দোকানদারের সাজেশন, দোকানের ভিজিবিলিটি ইত্যাদি । এর কোনটি তাকে পজেটিভলি প্রভাবিত করে, আবার কোনটি নেগেটিভলি । অনেকটা সেই সাপ-লুডু খেলার মত – কখনও সাপে খেয়ে পেছনে পাঠিয়ে দেবে আবার কখনও মই পেয়ে ধাঁই ধাঁই করে উপরে উঠতে যাবে । একজন মার্কেটিয়ারের কাজ যতটা সম্ভব সাপগুলো মেরে, সিঁড়ি বিছানোর ব্যবস্থা করা । সেই জন্যই একজন মার্কেটিয়ারের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো ভ্যালু চেইনের উপর দখল থাকতে হয় । এ্যাড সেই ভ্যালু চেইনের অতি সামান্য একখানা অংশ মাত্র ।
.
সুতরাং, একমাত্র জীবন বাঁচানো ইমার্জেন্সী ঔষধ আর স্বল্প-সময়ের জন্য দেয়া অসম্ভব টাইপের আকর্ষণীয় অফার ছাড়া এ্যাড দিয়ে সাথে সাথে সেলস্ বাড়িয়ে ফেলার পরিকল্পনা করাটা বোকামী ছাড়া আর কিছুই না । এ্যাড অবশ্যই আপনার ব্র্যান্ডের সেলসকে প্রভাবিত করবে । তবে তা সাথে সাথে নয় । কয়েক মাস, কয়েক কোয়ার্টার এমনকি অনেকক্ষেত্রে বছরও লেগে যায় একখানা থিমেটিক এ্যাডের প্রভাব আসতে এবং বুঝতে । তবে একবার যখন সেটি আসা শুরু করে, আর আপনি যদি পথের সাপগুলো সরিয়ে রাখতে পারেন, তবে আপনার ব্র্যান্ডটিও কনজ্যুমারের মাথার ভেতর বাড়ি-ঘর বানিয়ে চীরস্থায়ী রাজত্ব শুরু করে দেয় । সেলস নাম্বারের ঘোড়াটাও তখন ছুটতে থাকে জোরে । তবে তার জন্য সময় দিতে হয় । ইনভেস্টমেন্ট করে যেতে হয় । ধৈর্য্য থাকতে হয় । যদি সেই সময়, ক্যাপিটাল ব্যাকাপ আর ধৈর্য্যটুকু না থাকে তবে খামোখা এ্যাড দিয়ে টাকা নষ্ট না করাই ভাল ।
.
আর তাই এ্যাডের পেছনে খরচ শুরু করার আগে মার্কেটিয়ারদের উচিৎ ম্যানেজমেন্টের সাথে এই ব্যপারগুলো পরিষ্কার করে নেয়া – এই এ্যাড ক্যাম্পেইন থেকে বিজনেসে ঠিক কি ইম্প্যাক্ট আসবে এবং তা কবে । সেটি ঠিক না করে গেলে পরবর্তিতে যে ভয়ানক প্রেশারে পরবেন তখন এমনকি চাকরী এমনকি পুরো ক্যারিয়ারেরও বারোটা বেজে যেতে পারে ।
লেখাঃ Galib Bin Mohammad
Head of Marketing Arla